বেলাশেষ_নাকি_বেলাশুরু
পর্ব- ৪
চোখে যখন কারোর উপস্থিতি বুঝতে পারলো নন্দিনী তখন ভালো করে চোখ মেলে দেখলো সামনে তার কে দাঁড়িয়ে আছে।
কিছুক্ষন সেই ব্যক্তিটিকে দেখার পরই নন্দিনীর মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে।।
,
ওমা কাকাবাবু আপনি??
,
সেই ব্যক্তিটি বললেন,,,,,যাক চিনতে পেরেছিস তাহলে,,,আমি তো ভাবলাম এই জন্মে আর তোর সাথে দেখাই হবেনা আর।।সেই যে যোগাযোগ ছিন্ন হলো তোদের সাথে,,তারপর তো আর তোর টিকিটিও পেলামনা খুঁজে।।প্রিয়া তো অনেকবার তোদের বাড়িতে গেছিলো তোর খোঁজ নিতে,,কিন্তু তোর মা বাবা আমাদের কিচ্ছু জানায়নি।।
তারপর উনি ভালো করে নন্দিনীকে দেখে বললেন,,,,মা ,, রে আমাকে একটা কথা বলতো,,তোর এমন বিধ্বস্ত দশা কেন রে।। আর তুই একলাই বা এই স্টেশনে বসে আছিস কেন।।নিজের বাড়ি না গিয়ে।।
,
নন্দিনী একটু ম্লান হাসলো,,,,,বাড়ি????? আম,,,আমার তো কোনো বাড়ি নেই কাকাবাবু।।কথাটা বলার সময় নন্দিনীর গলাটা কেঁপে উঠলো একটু।।
,
অরুন জৈন,,,,,,( প্রিয়ার বাবা) :----- নন্দিনীকে ভালো করে দেখলেন,,,মেয়েটার চোখ মুখ বসে গেছে,,যেন কত ঝড় সহ্য করছে ঐ বুকের মাঝে।।চুল এলোমেলো,,,পরণের কাপড়টাও তেমনি অগোছালো।। গায়ে সোনা বলতে শুধু নাকচাবি,,হাতে শাখা পলা ,পায়ের জুতোটাও একপাশে ছিঁড়ে গেছে।।যে কেউ দেখলেই বলবে হয় ভিখারি নয়তো পাগলি।।।
অরুণবাবু ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,,,,,, নন্দু মা তোর কি হয়েছে রে,,আমাকে বল সব আমি তো তোর বাবারই মতো।।
,
অনেকদিন পর সেই বাবার মতো স্নেহ পেলো নন্দিনী কারোর থেকে।।কারণ বিয়ে হয়ে যাবার পর অভিরাজ ওকে খুব কম দিনই বাপের বাড়ি তে থাকতে দিয়েছে।। তাই নিয়ে সবাই যখন হাসি মস্করা করতো তখন নন্দিনীর মনে বয়ে চলতো গভীর কান্নার স্রোত।।কারণ আসল সত্যটা আর কেউ না জানুক সে জানতো ভালো করেই।।
অভিরাজের নিত্য নতুন যৌন অত্যাচার নন্দিনীকে সহ্য করতে হত প্রতি রাতেই।। পিরিয়ডের দিনগুলোতে শুধু ও রেহাই পেত,, কারণ অভিরাজের খুব পরিস্কারের বাতিক আছে।।তাই ওই 5 দিন ছিল ওর কাছে মুক্তির দিন।।এই 5দিন অভিরাজ বাড়িতেও ফিরতোনা।।ও যে কেন ফিরতনা বা কোথায় থাকতো সেটা জানারও অধিকার ছিলোনা নন্দিনীর।।।
,
কি রে মা তোর এই কাকাবাবুকে কি বলা যায় না??
,
নন্দিনী একবার দেখলো ওনার মুখের দিকে,,,,তারপর বললো,,,,,,কাকাবাবু আমাকে আমার স্বামী তাড়িয়ে দিয়েছে বাড়ি থেকে।। আর আমার বাপের বাড়ি বলতে আর কেউ নেই সেই ভাবে।।কিছু বছর আগেই বাবা আর মা মারা যায়,,, এক পিসি ছিলো উনিও গত হয়েছেন এক বছর হলো।।।আর এখন প্রিয়া ছাড়া এই কলকাতা কেনো গোটা পৃথিবীতেই আমার কেউ নেই।।।
,
অরুণবাবু বুঝলেন নিশ্চই বড়ো কিছু হয়েছে ,,,তা না হলে নন্দিনী এমন ভাবে বেরিয়ে আসতোনা।।।।
,
ওদের দুজন অসমবয়সী মানুষদের কথা বলতে দেখে স্টেশনে অনেকেই ভ্রু কুঁচকে দেখছে,,,,হয়তো নন্দিনীর বেশভূষায় তাদের মনে হয়েছে সে সুযোগ চাইছে।। তাই তিনি নন্দিনীকে বললেন,,,,,,,চল মা ওঠ,,,বাড়ি চল আমার সাথে।।।
,
বাড়ি চল ,,,,,কথাটা শুনে নন্দিনী একটু অবাক হয়ে দেখলে ,অরুন বাবু বললেন,,,,,,,,,,,,,প্রিয়ার থেকে কম কিছু ভাবিনা তোকে আমি।।প্রিয়া যেমন আমার মেয়ে ঠিক তেমনি তুইও আমার আরেক মেয়ে।।তাই আজ থেকেই আমরা তিন বাপ বেটি মিলে মজা করে থাকবো।।।
উনি উঠে স্টেশনের বাইরে গিয়ে একটা ট্যাক্সি করলেন ও নন্দিনীকে নিয়ে উঠে পড়লেন তাতে।।
এই যে ভাই কাঁকুড়গাছি চলো।।
,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,, নন্দিনী কাকিমা তো দারুন রান্না করে,,কি সুন্দর এই তরকারিটা করেছে রে।।ইশ আমি যদি তোর নিজের বোন হতাম তাহলে রোজ রোজ এমন ভালো সুস্বাদু খাবার আমিও খেতে পেতাম।।
,
নন্দিনী প্রিয়ার কথা শুনে চুপচাপ বসে মিটিমিটি হাসছে।। ওর মায়ের রান্নার কেউ প্রশংসা করলে ওর ভারী আনন্দ হয়,,গর্বে ফুলে ওঠে ওর বুক।।
তোমার পছন্দ হয়েছে এটাই অনেক ও বললো।।
,
পছন্দ মানে,,,দারুন ফাটাফাটি ।।যেকোনো ফাইভ স্টার হোটেলের রান্নাকে টেক্কা দিতে পারবে এই রান্না।।দারুন হয়েছে এই চিকেন কোপ্তাগুলো।।
,
প্রিয়ার চোখ বুজে তৃপ্তি করে খাওয়া দেখে আর ওর মুখে চিকেন কোপ্তা শোনার পর নন্দিনী একটু জোরেই হেসে উঠলো।
,
এই তুই হাসলি কেন? আমি কি ভুল বলেছি নাকি?
,
নন্দিনী আবারও হেসে বললো,,,,,হ্যা ভুল বলেছো।।
,
কেন এইগুলো চিকেন কোপ্তা নয়? অবাক হয়ে প্রিয়া জিজ্ঞাসা করলো।।
,
না এইগুলো চিকেন কোপ্তা নয়,,আমাদের বাড়িতে চিকেন কোনোদিনই খাওয়া হয়না।।তাই তুমি যেটা খাচ্ছ সেটা হলো সয়াবিনের কোপ্তা।।
,
হোয়াটটটট,,,,,,,,,, এটা সয়াবিন? তুই সত্যি বলছিস? বিস্ময়ে প্রিয়ার মুখ হা হয়ে যায়।।কারণ ও এর আগে ও সয়াবিনের কোনো খাবার ও খায়নি।।ছোট থেকেই ওর সয়াবিন পছন্দ নয়।।তাই এটাকে ও এভোইড করে।।কিন্তু ও ভাবতেই পারছেনা আজকে যেটাকে ও চিকেন কোপ্তা বলে তাড়িয়ে তাড়িয়ে খেয়ে উপভোগ করছিলো সেটা চিকেন নয় সয়াবিন।।
,
কি হলো তুমি হা করে কি ভাবছ?
,
আমি শুধু ভাবছি কাকিমার কি আশ্চর্য গুন।। যে আমি ছোটবেলা থেকেই এই সয়াবিন জিনিসটাকে দুচোখে দেখতে পারতাম না ,এখন সেই আমি কাকিমার রান্না করা সোয়াবিনের কোপ্তা তাড়িয়ে তাড়িয়ে খাচ্ছি।।
,
নন্দিনী মুচকি হেসে বলল জানো প্রিয়া আমার মায়ের আর একটা ভালো গুণ আছে।।
,
তাই নাকি শুনি আর কি কি গুন আছে কাকিমার।।
,
আমার মা খুব সুন্দর হাতের জিনিস তৈরি করতে পারে,, এই দেখো আমার হাতের চুড়িগুলো,, প্লেন চুরির ওপর আমার মা কি সুন্দর নকশা করে সেটাকে এক অন্য মাত্রায় সাজিয়ে দিয়েছে।।
,
প্রিয় ভালো করে চুড়িগুলো দেখে বলল ওয়াও কি সুন্দর করেছে রে কাকিমা।। প্লেন কাচের চুরিতে সুতো দিয়ে জড়িয়ে জড়িয়ে তার ওপর ছোট্ট ছোট্ট স্টোন বসিয়ে ডিজাইন করেছে।। সত্যি বলছি নন্দিনী, আমি কাকিমার ফ্যান হয়ে গেছি।। একদিন আমি তোদের বাড়িতে যাব কাকিমা সাথে আলাপ করতে।। কিরে নিয়ে যাবি তো।।
,
তুমি কবে যেতে চাও বল আমি তোমাকে নিয়ে যাব।।
,
ওদের কথার মাঝেই একটা ছেলে এসে প্রিয়াকে পিছন থেকে হাত করে বলল,,, প্রিয়া ডার্লিং, তুমি আমাকে ফেলে একা ক্যান্টিনে চলে এসেছো।।
,
পিছন থেকে নিজের প্রিয় মানুষের গলা শুনে প্রিয়া হাসি মুখে বলে,,, মোটেই না, আমি তোমাকে ফোন করেছিলাম ভালো করে ফোনটা চেক করো।। আর আমি তো একা আসেনি, তুমি কি সামনে দেখতে পাচ্ছ না ,আমার সাথে আর একজন আছে বসে।।
,
ছেলেটা সামনে তাকিয়ে নন্দিনীকে উপর থেকে নিচে পর্যন্ত ভালো করে মেপে দেখে নিল।। নন্দিনীর এই ছেলেটির চোখের দৃষ্টি বড়ই অস্বস্তিতে ফেলে দিল।।
,
হাই আমি নিলয়,,, নিলয় বাসু।।হাত বাড়িয়ে দিল হ্যান্ডশেক করার জন্য ।
,
নিরুপায় হয়েই নন্দিনী ইতস্তত করে হাত বাড়িয়ে দিল।। হ্যালো আমি নন্দিনী,,,নন্দিনী বসু রয়।।
,
কিন্তু নিলয় ওর হাতটা নিয়ে চেপে ধরে সামান্য ঘষে নিলো নিজের হাতের মধ্যে।।
নন্দিনী তাড়াতাড়ি নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলে,ও দেখলো নিলয়ের মুখে কেমন একটা রহস্যের হাসি।।
নন্দিনী নিজেকে সামলে নিয়ে প্রিয়াকে বললো,,,,তোমরা কথা বল আমার তো খাওয়া হয়ে গেছে আমি বরং নিজের ডেক্সে ফিরে যাই।।
,
আরে দাঁড়া না একসাথেই ফিরবো,,,,প্রিয়া বলে।।
,
হ্যা তুমিও আমাদের সাথেই আড্ডা দাও,আর তাছাড়া আমরা এমন কিছুই করবো না তোমার সামনে যেটাতে তুমি লজ্জা পাও।।বলেই নিলয় হাহা করে হেসে উঠলো।।
,
এই তুমি কেনো বেচারিটার পিছনে লাগছো,,সবে আজকেই ওর প্রথম দিন।।
,
ওহ তাই বল,,,,তাইতো ভাবি আমার চোখে আগে কেনো পরেনি,, বলেই একটা বিশ্রী নজরে আবার নন্দিনীকে মেপে নিলো।।
,
নন্দিনীর এই দৃষ্টির সামনে নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে ,,কিন্তু প্রিয়ার সামনে কিছু বলতেও পারছেনা।।প্রিয়া খুব সরল হাসি খুশি ও মিশুকে মেয়ে।। যেভাবে প্রথম দিনই ওকে এতটা আপন করে নিলো,, তারই মনের মানুষের বিরুদ্ধে কিছু বলতে পারলোনা তাই নন্দিনী।।
,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,নন্দু মা উঠে পর এসে গেছি আমরা।।অরুন বাবুর ডাক শুনে হড়বড়িয়ের উঠতে গেলো নন্দিনী।।কিন্তু কাল থেকে না খাওয়া শরীরে যে আর কোনো জোর অবশিষ্ট ছিলনা,,তাই মাথাটা ঘুরে গেলো নামতে গিয়ে।।
,
সামলে নন্দু মা ,,,,,,ছুটে ধরে নিলেন তিনি।। কি রে মা তুই ঠিক আছিস তো? আমারই ভুল এইভাবে তোকে ডাকা উচিত হয়নি।।
,
নিজেকে খানিকটা সামলে নন্দিনী বললো,,,,,,আমি ঠিক আছি এখন,,ঐ একটু মাথাটা ঘুরে গেছিলো।।চলো যাই।।
,
ভাড়া মিটিয়ে দুজনেই এগিয়ে চললো একটা বড়ো কমপ্লেক্সের সামনে।।গেট খুলে দারোয়ানকে বললো,,,,,এই মেয়েটা কে চিনে রাখো,,এ আজ থেকে এখানেই আমাদের সাথে থাকবে।।আমার আরেক মেয়ে, নাম নন্দিনী।।
,
জি সাব মনে থাকবে।।।
,
তারপর ওরা এগিয়ে গেলো লিফটের দিকে।।
,
14 তলা লিফটের বাটন পরেশ করতে করতে অরুন বাবু বললেন,,,,,,আজকে তোর বন্ধু খুব চমকাবে।।খুব খুশি হবে তার বেস্ট ফ্রেন্ডকে দেখলে।।
,
নন্দিনীও একটু হাসলো,,,,,কি ভাগ্য ওর, যেখানে জন্মে ছিলো একদিন সেই বাড়ি থেকে প্রায় ভুল বুঝেই ওর বিয়ে দিয়ে ওকে পর করে দিয়েছিল,,,আর যেখানে বিয়ে হলো সেই বাড়ি থেকে আজ তাকে ঘার ধাক্কা দিয়ে বার করে দেওয়া হলো। অথচ এই দুই বাড়িই তার নিজের কাছের মানুষদের,,এক বাপের বাড়ি ও দুই শশুরবাড়ি।।
আর আজ যেখানে ওর ভাগ্য নিয়ে এসেছে সেখানে মাত্র তাদের সাথে ওর বন্ধুত্বের সম্পর্ক।।তবুও সেই সম্পর্ক কতটা গভীর কতটা মজবুত, যে বিনা জাজমেন্টে ওকে কত সহজে আপন করে নিল।।
,
টিং টং,,,,,,,,,,,,,,,,, দরজায় বেলের আওয়াজ হতে ভিতর থেকে একজন বললো,,,,,,,,,,,,,আসছিইই।।
,
ওহ বাপি তুমি এসো ,,অনেক দেরি হয়ে গেলো যে তোমার ফিরতে।। দরজা খুলে ভিতরে যেতে যেতে বললো মেয়েটি।।
,
প্রিয়া দ্যাখ কে এসেছে !!
,
যেতে গিয়েও বাবার মুখের কথা শুনে সামনে ফেরে প্রিয়া,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,তুই!!!!
________________চলবে___________________
Thanks for your feedback