Translate

বেলাশেষ_নাকি_বেলাশুরু || পর্ব :- ১

 #বেলাশেষ_নাকি_বেলাশুরু



#পর্ব :- ১








njp তে যখন ট্রেনটা থামলো তখন সবে ভোরের আলো ফুটছে,,,,,একটা বছর 35 এর এক মধ্য বয়সী মহিলা উদ্ভ্রান্তের মতো অবিন্যস্ত অবস্থায় ছুটে চলেছে প্ল্যাটফর্মের দিকে।। শিয়ালদাহ টু নিউ জলপাইগুড়ির ট্রেনে সে যখন উঠলো তখন অনেকেই ওকে অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছে,, কিন্তু সেদিকে তার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই।।

ট্রেনের এক কামরায় সে নিজেকে গুটি সুটি করে বসে রইল,,, থেকে থেকেই তার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে ও সেটা সে বারংবার মুছে যাচ্ছে তার আঁচল দিয়ে।। আর নিজের খেয়ালেই বিড়বিড় করে বলে যাচ্ছে,,, *ঠকে গেলি তুই ,,ঠকে গেলি নন্দিনী।। কি পেলি এত ভালো হয়ে,, যাকে ভালবাসলি, সংসার করলি যার সন্তানের জননী হলি,, শেষ অব্দি সেও তো তোকে ঠকালো।। যে সন্তানের জন্য সব দুঃখ কষ্ট সহ্য করে তুই ওই সংসারে অবাঞ্চিতের মত পড়েছিলিস সেই সন্তানও আজকে তোকে অস্বীকার করে।। কি পেলি? এত ভালোবেসে এত আগলে রেখে।। তুই আজকে হেরে গেছিস নন্দিনী,, হেরে গেছিস তুই সেই সংসারে, হেরে গেছিস তুই ছেলের কাছে, আর হেরে গেছিস তোর ভালোবাসার কাছে।।

,

একে একে যখন সব যাত্রী ভরে ট্রেন চলতে শুরু করল তখন সকাল হয়ে গেছে।। ওই কামরায় থাকা সবযাত্রীরাই ওকে কৌতুহলী নজরে দেখতে থাকে।। উদাস নয়নে বাইরে সব দৃশ্য একে একে যখন তার চোখের সামনে থেকে সরে যাচ্ছিল, তখন তার স্মৃতির মানস পটে তার ফেলে আসা কিছু দৃশ্য, তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে।।

,

উত্তর কলকাতার মেয়ে নন্দিনী ,,নন্দিনী বসু রয়।। মা-বাবার এই একটাই সন্তান সে।। তাও অনেক কষ্ট করে পেয়েছিলেন নন্দিনীর মা সুনন্দা দেবী।। কারণ অনেক বয়সেই তিনি সন্তান ধারণ করতে পারেন।। বহু বছর চিকিৎসা করিয়ে, মানত করে ঠাকুরের কাছে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকার পরে সুনন্দা দেবী ও পলাশ বাবু তাদের একমাত্র সন্তান নন্দিনীকে পায়।। উত্তর কলকাতার বনেদি আনায় মানুষ নন্দিনী,,, তাই ধীর স্থির শান্তশিষ্ট নন্দিনী কোনদিনই মুখরা নয়।। বরাবরই সে নিজের কষ্ট নিজের মধ্যে লুকিয়ে রাখতে ভালোবাসতো।।

বাড়ির একটাই সন্তান যদি কন্যা সন্তান হয়, আর কোনো বংশ প্রদীপের আশা না থাকায়,, ননীবালা দেবীর চোখের বালি ছিল নন্দিনী। উঠতে বসতে সুনন্দা দেবীকে তিনি কথা শোনাতেন।। এমনকি ছোট নন্দিনীকেও কোনদিন কাছে টেনে নেননি তিনি।। ঠাম্মির এই অবহেলা ছোট নন্দিনীর মনে খুব কষ্ট দিত।। যখন সে দেখতো তার পিসির ছেলেকে ঠাম্মি আদর করে কাছে টেনে কত কিছু দিচ্ছে,তার খাওয়ার চেয়ে যত্ন করছে।। অথচ তাকে কোনদিন এইভাবে খাওয়ানো তো দূর কাছে ডেকে মিষ্টি করে মাথায় হাতও রাখেনি তার ঠাম্মি।। ছোট্ট অবুঝ নন্দিনীর চোখ দিয়ে অনবরত জল পড়তো, মাকে বলতো জড়িয়ে ধরে মা ঠাম্মি কেন ভাইকে ভালোবাসে,,? আমাকে কেন ভালোবাসে না।।

ছোট মেয়েটির দিকে তাকিয়ে তার মা তাকে বোঝাতেন,, আসলে ভাই তো ছোট তাই তো আমি ভাইকে ভালোবাসে,, ভাইকে তো তুমিও ভালোবাসো নন্দু ,,বাসনা ভালো ভাইকে ?

ছোট্ট নন্দিনী বলতো খুব ভালবাসি ভাইকে আমি। কেন ভালোবাসবো না? ও তো আমার একমাত্র ভাই।। তবুও আমারও তো ইচ্ছা করে মা ঠাম্মি আমাকে একটু আদর করুক।। অবুঝ মেয়ের বায়না দেখে সুনন্দা দেবীর চোখে জল গড়িয়ে পড়তো।।

তিনি মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলতেন,,, আমি আর তোর বাবা তোকে অনেক ভালোবাসি।। আমাদের এই ভালোবাসাটা কি তোর কম পড়ছে?

,

মাকে জড়িয়ে ধরে বুকের মধ্যে মুখ গুজে নন্দিনী বলতো,,,, একদমই না আমার কারোর ভালোবাসা দরকার নেই মা ।তুমি ভালবাসলেই হবে আর বাবা ভালবাসলেই হবে।। আমি আর কোনদিনই বলবো না মা, তুমি কেদনা।।

,

অতটুকু মেয়ের মুখে এই কথা শুনে সুনন্দা দেবী চোখের জল মুছে হালকা হাসলেন তারপর বললেন,,, আমি জানি আমার নন্দিনী খুব বুঝদার।। আর তাইতো আমি আমার মেয়েকে এতটা ভালবাসি।।

পলাশ বাবুর ঠাকুরদার ঠাকুরদারা ছিল সেই সময় জমিদার।। রায় উপাধি টা ওরা সেই সময় পেয়েছিলেন।। তবে এখন এই রায় উপাধি আর ভগ্ন জমিদার বাড়ি ছাড়া আর কিছুই নেই নন্দিনীদের।। তাও আবার শরীরি বাড়ি।। নন্দিনীর বাবাও ছিল একমাত্র সন্তান। কারণ পলাশ বাবু জন্মাবার দু বছরের মধ্যেই নন্দিনীর দাদু মারা যান।। নন্দিনী যাকে পিসি বলে তিনি পলাশ বাবুর কাকার মেয়ে।। উনার নাম অদিতি ঘোষাল।

অদিতি দেবী আর সুনন্দা দেবী একই কলেজে বন্ধু ছিলেন। আর সেই সূত্রেই নন্দিনীদের বাড়িতে সুনন্দা দেবীর যাতায়াত ছিল।। বরাবরই পলাশ বাবু একটু শান্ত গোছের,, তবুও এই মুখচোরা শান্ত ব্যক্তিটিকেই সুনন্দা দেবীর পছন্দ হয়।। বন্ধুর মনের কথা জেনেই একদিন অদিতি পলাশ বাবুকে বলেন,,, আচ্ছা দাদাভাই তোর সুনন্দা কে কেমন লাগে।। 

,

বোনের মুখে তার বান্ধবীর কথা শুনে স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা অবাক হয় পলাশ বাবু।। তিনি বলেন ,,,হঠাৎ আমাকে এই কথা কেন বলছিস ছুটকি।।

,

না আসলে দাদাভাই বলছিলাম কি তোর তো বিয়ের জন্য মেয়ে দেখছে বাড়ি থেকে,,তাই আমি ভাবছিলাম সুনন্দা কে তোর কেমন লাগে।।আসলে নিজের বন্ধু বলে বলছি না সুনন্দার মত লক্ষী মেয়ে খুব কম পাওয়া যায়।।মামার বাড়িতে অবহেলিতভাবে মানুষ হয়েও সুনন্দার মত লক্ষী মেয়ে কিন্তু একটাও নেই।।আমি জানি দাদাভাই আমাদের বাড়িতে প্রেম করে বিয়ে করা একেবারেই মানা।।কিন্তু আমি তাও বলবো তুই একবার হলেও সুনন্দার সাথে কথা বল।।

,

পলাশবাবু কিছুটা ভেবে বললেন,,,সবই তো বুঝলাম কিন্তু যে মানুষটার সাথে আমি কথা বলব তার কি আমার জন্য মনে কোন অনুভূতি আছে?

,

অদিতি দেবী একটু হেসে বলল,,,,আমার বন্ধুটা বড্ড বেশি মুখচোরা ঠিক তোরই মতো।।তবে তার চোখে আমি তোর প্রতি শ্রদ্ধা দেখেছি।।

,

পলাশ বাবু আরেকটু অবাক হয়ে বলল,,সে আমাকে কখন দেখেছে,,কই আমি তো তাকে লক্ষ্য করিনি।।

,

ও যখন আমার সাথে কলেজে যাওয়ার জন্য আসে,,তুই তখন অফিসে বেরোনোর জন্য রেডি হোস।।তখনই ও তোকে দেখে প্রায় প্রত্যেকদিনই।।তুই হয়তো ওকে খেয়ালই করিস নি।।

,

পলাশ বাবু মনে বললেন,,,,আমি সব খেয়াল করি ছুটকি তোর বন্ধুকেও আমি খেয়াল করেছি।তবে সে কথা আমি তোর মুখের সামনে বলতে পারব না।।যখন আসল মানুষটার সাথে দেখা হবে তখনই না হয় তাই সে জানবে।।তারপর তিনি বললেন,,,সে না হয় ঠিক আছে কিন্তু মা কি মানবে?আর তুই জানিস মায়ের নির্দেশ ছাড়া আমি কিছুই করতে পারবো না।।

,

সেটা তুই আমার ওপর আর তোর কাম্মার উপর ছেড়ে দে।।দেখ দাদা ভাই জেম্মা কিন্তু আমার মায়ের কথা শোনে,,,আর মা এমনিতেই সুনন্দাকে খুব ভালোবাসে।।স্পেশালি ওর হাতের রান্না ও হাতের কাজ।।তাই আমি যদি মাকেই প্রস্তাবটা দিই মা কিন্তু লুফে নেবে।। তবে তার আগে তোকে কিন্তু সুনন্দার সাথে একবার কথা বলতে হবে।

,

ঠিক আছে সে না হয় আমি একবার দেখা করে নেব তুই ওকে জানাস,,আগামী শুক্রবার কফি হাউসে বিকেল 5 টার সময় আমি ওর জন্য অপেক্ষা করবোআমি ওর জন্য অপেক্ষা করবো। ও যেন ঠিক সময় চলে আসে।।

,

থ্যাংক ইউ দাদাভাই আমার কথাটা রাখার জন্য আমি জানি তুই ঠকবি না।।নিজের বন্ধু বলে বলছি না সুনন্দার মত মেয়ে সত্যি হয় না।।

,

আরে! বাবাহ নিজের দাদাকে এতবার থ্যাঙ্ক ইউ বলার দরকার নেই।।আমি জানি তুই আমার ভালোর জন্যেই বলেছিস।।তবে তাই হোক কফি হাউসে শুক্রোবার বিকেল পাঁচটায় তোর বন্ধুকে আসতে বল,,আর এখন আমি নিচে যাই কারণ অনেক কাজ পড়ে আছে।।

,

ঠিক আছে দাদাভাই তুই যা।।


শুক্রবার বিকাল পাঁচটা কফি হাউস

--------------------------------:- বাস থেকে নেমেই বাস থেকে নেমে তাড়াহুড়োতে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলো সুনন্দা।।ইস 5:30 বেজে গেছে,,উনি মনে হয় চলেই গেছেন অপেক্ষা করতে করতে।।কিন্তু আমি কি করবো টিউশনি টা শেষ করতেই তো ৫:১০ বেজে গেল।।যদি উনি চলে যান তাহলে আমি অদিতিকে কি জবাব দেবো,কোন মুখে বলবো যে আমি ঠিক সময় আসতে পারিনি।।

যখন ম্লান মুখে সুনন্দা ফিরে যাচ্ছিল,,তখনই ওর কানে গেল একটা পরিচিত গলার স্বর।।ওর নাম ধরে কেউ ডাকছিল।।কাঙ্ক্ষিত মানুষের গলার স্বরটি শোনার পরই , পিছনে ফিরে যখন সুনন্দা দেখল,তার ভালোবাসার মানুষটি তার জন্য অপেক্ষা করে আছে ফিরে যায়নি তখন তার ক্লান্ত মুখটা হঠাৎই উজ্জল হয়ে উঠলো।।

,

সুনন্দাকে অনেক আগেই পলাশ দেখেছিল বাস থেকে নামতে,,আর সে যে অস্থিরভাবে তাকেই খুঁজছে সেটাও সে বুঝেছিল।।তবুও ও সামনে আসেনি কারণ ও বোঝার চেষ্টা করেছিল সুনন্দা মন আদেও পলাশকে খোজে কিনা।যখন পলাশ দেখল ম্লান মুখে সুনন্দা ফিরে যাচ্ছে ওকে না খুঁজে পেয়ে,,তখন আর নিজেকে আটকে রাখতে পারল না পলাশ।।সুনন্দা কে ডাক দিল,,ওর গলার আওয়াজ শুনে যখন সুনন্দার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল,,তখন পলাশে যা বোঝার সেটা বোঝা হয়ে গেছে। ওরা দুজনে মিলেই কফি হাউসের ভেতরে একটা কোনের দিকে টেবিলে গিয়ে বসলো।।

কিছুটা সংকোচই হোক বা নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে সামনে বসে থাকতে দেখে,একটু অপ্রস্তুতে পড়লো সুনন্দা। অপরদিকে মানুষটারও একই অবস্থা,,তবুও পলাশ বাবুই প্রথম পদক্ষেপ নিল।।

,

গলা খাকরে সুনন্দাকে বলল,,,,আপনাকে কি আমি সুনন্দা বলেই ডাকবো?

,

একবার মুখের দিকে তাকিয়ে সুনন্দা শুধু ঘাড় নাড়লো হ্যাঁ বলে।।

,

ওর অবস্থা দেখে পলাশ বাবুর একটু হাসি পেল তাই রসিকতা করার লোভটা ছাড়তে পারল না।।

,

পলাশ বাবু বললেন,,,,,,,ছুটকির মুখে তো আপনার অনেক কথাই শুনেছি,,তো আপনি আমাকে পছন্দ করেন তাইতো,,আর যদি আমাকে পছন্দ করেন তাহলে আমার সাথে কথা বলছেন না কেন।।

,

পলাশ বাবুর মুখে এই কথাগুলো শুনে সুনন্দা দেবীর মুখ আরো নিশুর দিকে নেমে গেল ।লজ্জায় উনি তাকাতে পারছিলেন না।মনে মনে অদিতিকে বলতে লাগলেন,, কি দরকার ছিল তোর অদিতি তোর দাদাকে এসব কথা বলার জন্য।।এখন আমি কি করে উনার দিকে তাকাই লজ্জায় যে আমার এখন মনে হচ্ছে,, হে ধরণী দ্বিধা আমি তোমার কাছে সমর্পণ করি নিজেকে।।

,

সুনন্দা দেবীর লজ্জা মাখা মুখটা দেখে,,পলাশ বাবুর মনে একটা ভালোবাসার রেশ বয়ে যায়।।তিনি একটু আবেগি হয়ে সুনন্দা দেবীর একটা হাত ধরে বলেন,,,,আমি জানি সুনন্দা।তুমি আমাকে পছন্দ কর,,আজকে আমি সেই জন্যেই তোমাকে এখানে ডেকেছি,,।।

,

একটু অবাক হয়ে পলাশ বাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল সুনন্দা।।

,

ওকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে পলাশ বাবু একটু হেসে বললেন,,,,,এত অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকো না নন্দা,,,,হ্যাঁ তোমাকে আমি আজ থেকে নন্দা বলেই ডাকবো।।শুধু তুমি যে আমাকে পছন্দ কর তা কিন্তু নয়,,আমিও তোমাকে পছন্দ করি।।অবাক হওয়ার কিছু নেই আমি অদিতিকে এই কথাটা বলতে পারিনি। কারণ তুমি নিশ্চয়ই জানো আমি একটু মুখচোরা টাইপের মানুষ।।তবে যাকে আমি ভবিষ্যতে নিজের স্ত্রীহিসাবে নিজের জীবনে আনবো, তার কাছে আমি খোলা বই হতে চাই।।তোমাকে বলতে আমার লজ্জা নেই নন্দা জীবনে কিন্তু প্রথম নারী তুমি।।তুমি কি ভাবলে আমি তোমার চোরা নজর লক্ষ্য করিনি।।পাড়ায় দুর্গা ঠাকুর আনার সময় যখন তুমি আমাকে লুকিয়ে লুকিয়ে অদিতির পেছন থেকে দেখতে,আমিও কিন্তু সবার অলক্ষে তোমাকে ঠিক দেখে নিতাম।।আর আমাদের বাড়িতে অদিতিকে যে রোজ ডাকতে আসো কলেজে যাবার জন্য,,তুমি কি এটা লক্ষ্য করনিতুমি কি এটা লক্ষ্য করনি? আমিও ঠিক একই টাইমে সেই সময় অফিসে বেরোতাম।।আর এর জন্য প্রত্যেকদিন আমার লেট হতো।।তাও আমিতাও আমিতাও আমি শুধুমাত্র তোমাকে একবার দেখার জন্যওই সময় অফিসে বের হতাম।।

,

পলাশ বাবুর অপকট স্বীকারোক্তিতে লজ্জায় মাথা নত হয়ে আসলো সুনন্দা দেবীর।।।

,

পলাশ বাবু আর একটু শক্ত করে ওনার হাতটা ধরে বললেন,,,আমি ছুটকির থেকে তোমার মামার বাড়ির অবস্থা শুনলাম,,আমি বুঝতে পারছি তুমি ওখানে ভালো নেই,। তবে চিন্তা করো না,,ছুটকি কাম্মার সাথে কথা বলেছে,,আর কাম্মাও মায়ের সাথে এই বিষয়ে কথা বলেছে।।তুমি ধরে নাও আগামী সপ্তাহেই আমরা তোমার মামার বাড়ি যাচ্ছি।।আর সেদিনকেই পাকা কথা আমরা বলে আসবো।।

,

পলাশ বাবুর মুখ থেকে এই কথাগুলো শোনার পর,সুনন্দা দেবীর চোখে জল চলে আসে।।ও মুখ তুলে পলাশ বাবুকে কিছু বলার জন্যকিন্তু তার আগেই পলাশ বাবু উনার চোখের জল মুছে বললেন,,,,আর না নন্দা আর কেঁদোনা।।আমাদের বাড়িতে প্রেম করে বিয়ে করা রেওয়াজ নেই,,তবুও দেখো আমরা কিন্তু নিজেদেরকেই পছন্দ করে বেছে নিয়েছি।।শুধু এটা সবার সামনে দেখে শুনে বিয়ের মত প্রেজেন্ট করতে হবে।।যাতে আমার মা সন্দেহ না করে আর মনে কষ্ট যেন না পায়।।

পলাশ বাবুর কথা শুনেএতক্ষণ বাদে সুনন্দা দেবীর মুখে হাসি ফুটে উঠলো।।উনি বললেন,,,,আপনি যখন সবই বুঝতে পেরেছিলেন,তবে অদিতির কাছে কেন বললেন না যে আপনি আমাকে আগেই পছন্দ করতেন।।

,

আমি যদি ছুটকির কাছেই স্বীকার করতাম,তবে এখন তোমার মুখের এই লজ্জা আর হাসি করে দেখতে পেতাম।।

,

দুজনেই হেসে উঠলো ওদের কথায়।।।এই ভাবেই সুনন্দা দেবী ও পলাশ বাবু এক সময় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন।।।

তারপরএকে একে পাঁচ বছর ছ বছর কেটে যাওয়ার পরও যখন সুনন্দা দেবীর কোল আলো করে কেউ এলোনা,,তখন স্বাভাবিকভাবেই সুনন্দা দেবী কে সকলের কটু কথাশুনতে হচ্ছিল।।বিশেষত নিজের শাশুড়ি মায়ের থেকে।।কিন্তু পলাশ বাবু কোনো দিনের জন্যেও সুনন্দা দেবীক কোনরকমের অপমানকটু কথা জীবনেও বলেনি।।বরং ওনাকে সব সময় সাহস দিয়েছেন,বলেছেন ভগবান যদি আমাদেরভাগ্যে সন্তান লিখে রাখে তবে হবে।।তার জন্য তোমাকে মন খারাপ করে থাকতে হবে না নন্দা।।যদি সন্তান নাও আসে,,তবুও আমি তোমাকে নিয়ে সারা জীবন এভাবেই কাটিয়ে দেবো।।।তারপর তো একে একে অনেক ধরনের টেস্ট ও ঠাকুরের মাদুলি নানা ধরনের উপোস আচার অনুষ্ঠান করে শেষে তাদের কোন আলো করে এলো তাদের মেয়ে নন্দিনী।।।

মেয়ে হয়েছে বলে পলাশ বাবু আর সুনন্দদা দেবীর খুব আনন্দ হয়।। তাদের এই সময় একমাত্র তারা পাশে পেয়েছিল সুনন্দার বন্ধু কাম ননদ অদিতি দেবীর।।

তাই আজও অদিতি দেবীর সাথে সুনন্দা দেবীর অটুট বন্ধন থেকেই গেছে।

,

ট্রেনটা ঝাকুনি দিয়ে যখন থামলো,,তখন নন্দিনীর ধ্যান ভাঙলো সেই ঝাকুনিতে।।একবার বাইরে মুখ বাড়িয়ে দেখল কোন স্টেশন এসেছে,,কিন্তু সামনে একটা মালগাড়ি থাকায় ও সেটা দেখতে পায় না।।নন্দিনী মনে মনে ভাবল,,,,,কি আর হবে দেখে এই ট্রেনের শেষ গন্তব্য তো শিয়ালদাহ।।কিন্তু তার গন্তব্য কোথায়? সে এখন কোথায় যাবে।।পৈত্রিক বাড়ি বাড়ি যেটা ছিল,,সেটা মা মারা যাবার পর সবাই মিলে,সই দিয়ে প্রোমোটারের হাতে তুলে দেয়া হয়েছিল,,,কারণ তার বাড়ি তো নর্থ বেঙ্গলে,,তার বিয়ে হয়েছিল অভিরাজের সাথে।।চাকরির জন্য অভিরাজ নর্থ বেঙ্গলে থাকে।।তাই বাবা মা মারা যাবার পর আর পিছুটান রাখেনি নন্দিনী।।।যখন সবাই বলল সই দেবার জন্য তখন দ্বিমত করেনি সে।।নিজের শেষ সম্বল ওই বাড়ি থেকে পাওয়া প্রাপ্ত টাকাটাও সে নিজের একমাত্র সন্তানের নামে লিখে দিয়েছিল।কারণ সে তখন জানতো,,তার নামে থাকা আর সন্তানের নামে থাকা একই।।কিন্তু আজ সে জানে তার নিজের বলে কোন জিনিসই নেই।না তার সন্তান, না তার টাকা ,আর না তার সংসার।।

আছে বলতে তার হাতে সামান্য কটা জমানো হাজার দুয়েক টাকা,,যেটা সে নিজের হাতের কাজ করে জমিয়েছিল।।আর আছে তার সার্টিফিকেট।।এইটা সে মনে করে নিয়ে আসে তার সাথে।।আর একটা ছোট ডাইরি যেখানে তার বন্ধু প্রিয়ার ফোন নাম্বার।।

কারণ তার শেষ সম্বল বলতে ,শেষ নিজের মানুষ বলতে,তার এই বন্ধুটিই আছে।।


কালকে রাতে যখন অভিরাজ ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ছেলের সামনে ঘর থেকে বের করে দিল,তখন আকুল হয়ে অভিরাজের পায়ে অব্দি সে পড়েছিল।।

কিন্তু অভিরাজ তার একটা কথাও শোনেনি,,,যখন নন্দিনী নিজের ছেলের কাছে গিয়ে বলল আমাকে ছাড়া তুই থাকতে পারবি?তুই তো এখনো অতটা বড় হোসনি সোম।।কি করে থাকবে আমাকে ছাড়া? বাবাকে বুঝিয়ে বলনা আমাকে যেন তোর থেকে দূরে না করে।।

,

বছর বার সোমরাজ বলে উঠলো,,,,ইউ নো মম আই এম নট এ কিড।।আর তোমারই প্যান প্যানানো স্বভাবটা না আমার ঠিক সহ্য হয় না।।ড্যাড কি দেখে তোমাকে বিয়ে করেছিল আমি সেটাই ভাবি।।আমার আরো অনেক বন্ধুরা আছে তাদের মায়েরা আছে,,জাস্ট তাদের একবার দেখো, তারা কতটা মর্ডান।নিজেদেরকে কতটা আপটুডেট করে রেখেছে তারা।।আর দেখো তোমাকে,,জাস্ট দেখলেই ইরিটেটিং হয়।।সেই বস্তা পচা শাড়ি পরা মধ্যবিত্তদের মত।।তার ওপর শাখা পলা করেছ মানে কেমন একটা টাইপের হয়ে থাকো সব সময়।।আর তোমার নিজস্ব গুণ বলতে কি আছে হ্যাঁ তুমি একটু ভালো রান্না করতে পারো।ব্যাস আর কিছু গুণ নেই কিন্তু তোমার।।না তুমি ভালো করে ইংলিশ বলতে পারো না লোকের সাথে ভালো করে বুঝতে পারো নাথিং।।

ড্যাড কতবার তোমাকে বলেছে একটু নিজেকে আপটুডেট করতে।।কিন্তু তুমি যে কে সেই একিই রয়ে গেলে।।আজকে ড্যাড যদি তোমার থেকে মুক্তি পেতে চায় তাহলে আমি সম্পূর্ণভাবে ড্যাড এর পক্ষেই থাকবো।।ইউ নো হোয়াট ,,মা!! তোমার মত মেয়ে যে ড্যাড এর মত একজন হাজব্যান্ড পেয়েছিল সেটা তোমার ভাগ্য।।তুমি না ড্যাডকে ডিজার্ভই করো না।।প্লিজ এখন এসব ন্যাকা কান্না কেঁদো না। আমি মোটেই তাতে গলে যাবো না।।

,

ছেলের মুখে এইসব কথা শুনে নন্দিনী মনে হলো পায়ের তলা থেকে মাটিটা মনে হয় কেউ কেড়ে নিল।।

কারণ যাকে জন্ম দিতে গিয়ে নন্দিনী প্রায় মরতে বসেছিল।।অনেকটা লড়াই করে সে সোম কে জন্ম দিয়েছে।।প্রিম্যাচিউর ছিল সোম।।তাই অনেক যত্নে অনেক পরিশ্রমে আস্তে আস্তে নন্দিনী তাকে বড় করে তুলেছে।।আজকে সেই ছেলের মুখেই যখন এইসব কথা শোনে তখন তার নিজেকেই ধিক্কার দিতে মন চায়।।কিছু কি কম হয়ে গেছিল সোমের প্রতি ওর ভালোবাসা নাকি যত্ন।।ওর যতদূর মনে হয় সারাদিন কাজ করার পরেও সোম যখনই কেঁদে উঠতো,ক্লান্ত দেহ না চাইলেও সারারাত ধরে সোম কে বুকে জড়িয়ে ঘুম পারাতো।।তারপর সে ঘুমিয়ে পড়লে,যখন নিজেকে একটু বিছানায় আরাম দেবার কথা ভাবতো,,তখনই তার স্বামী অভিরাজ স্বামীত্বের অধিকার ফলাতো তার শরীরে।।এত বছর সংসারে নিজেকে নিংড়ে দেবার পরেওযখন তাকে এইসব কথা শুনতে হয়,,তখন তার মন এমনিতেই মরে যায়।তবুও নিজেকে একটিবারের জন্য তুলে ধরে অভিরাজকে বলে,,ঠিক আছে আমি চলে যাব তোমাদের বাড়ি থেকে,,তবে কটা জিনিস আমার আছে সেগুলো যদি আমাকে সময় অনুমতি দাও,তবে খুব উপকৃত হই।।

,

তাচ্ছিল্য স্বরে অভিরাজ বলে ,,তোমার জিনিস তোমার আবার কোথায় কি জিনিস আছে।।যতদূর জানি এই বাড়িটা আমার এখানে প্রত্যেকটা জিনিসই আমার।।এমনকি তুমি যে এই শাড়িটা পড়ে আছ সেটাও আমার দেওয়া।।তাহলে এখন বলো তোমার কি আছে।।

,

ম্লান হেসে নন্দিনী বললো,,,,,,,ভয় নেই অভি আমি তোমার কিচ্ছু জিনিস আমি নেবোনা,,,বলতে পারো নেবার ইচ্ছেও আমার নেই।।তবে আমাদের ঘরে আমার বাবা ও মায়ের একটা ফটো আছে,,,আমার আর কিছু নিজস্ব কাজ করে জমানো টাকা আছে তাও বেশি নয়,,হাজার দুয়েক টাকাই হবে।আর আছে একটা ছোট ডায়েরি ও আমার কিছু সার্টিফিকেট।।

,

নন্দিনীর কথা শুনে ওর ছেলে সোম বলল,,,ড্যাড প্লিজ মাকে এগুলো তাড়াতাড়ি নিয়ে এখান থেকে যেতে বল,,,আমি না এই নাটকটা আর নিতে পারছি না, এই মহিলাটাকেই আমি সহ্য করতে পারছি না।।

,

তুমি কিছু ভেবো না বেটা তুমি ঘরে যাও নিজের নতুন কেনা ল্যাপটপে ইনজয় করো।আমি এই মহিলাকে একটু বাদেই বিদায় করছি।।

,

স্বামী ও নিজের সন্তানের কাছে এইরূপ কথা শুনে,নন্দিনীর চোখের জল বাঁধ মানে না,,তবুও নিজেকে কিছুটা সামলে বলে,,,আমাকে পাঁচ মিনিট সময় দাও আমি এক্ষুনি সব নিয়ে চলে আসছি।।

,

ঠিক আছে যাও তবে আমিও তোমার সাথে যাব।।বলা তো যায় না যদি কিছু আমার এক্সপেন্সিভ কোন জিনিস নিয়ে নাও,,,কারণার বাবা-মা তো তোমাকে এক কাপড়েই আমার সাথে বিদায় করেছিল।দেওয়ার মধ্যে ওই একফালি একটা গলার সোনার চেন আর একটা আংটি।।যেগুলো আমার কোন কাজেই লাগে না।।পারলে ওটাকেও সঙ্গে করে নিয়ে যাবে নিজের সাথে।।তবে আমি যে কটা গয়না তোমাকে গড়িয়ে দিয়েছিলাম বা আমার বাড়ি থেকে যে যে গয়না গুলো তুমি পেয়েছো , তাতে যদি তুমি হাত দাও,তবে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না।।মা না হয় সরল মানুষ ছিল কিন্তু আমি তো সরল নই ,তাই তোমার মত একটা মিডেল ক্লাস মেয়েকে আমি এই সব গয়না কিছুতেই নিয়ে যেতে দেব না।

,

নিজের চোখে জলটা মুছে নন্দিনী বলল হয়নি অভিরাজ,,আমি কিচ্ছু নিয়ে যাবো না নিজের সাথে।।যেটুকু গয়না আছে আমার সেইগুলো আমি সোমকেই দিয়ে যেতে চাই। যাতে ভবিষ্যতে একদিন হলেও নিজের মায়ের কথা তার মনে পড়ে।।আমি তোমাকে যেটুকু বলেছি সেটুকুই শুধু নিজের সাথে নিয়ে যাব।।আমি যে মিথ্যে কথা বলতে পারি না সেটা অন্তত তোমার থেকে ভালো কেউ জানে না।।তবুও যদি তোমার মনে আমাকে নিয়ে সন্দেহ হয় তবে আমার সাথে চলো ঘরে নিজেই দেখে নেবে আমি কি কি জিনিস নিয়ে যাচ্ছি নিজের সাথে।।যেখানে নিজের এতটা বছর নিজের মানুষদের জন্য দিয়ে দিলাম,,সেখানে ওই কটা মাত্র গয়না নিয়ে আমার লাভ কি।।আমার নিজের বলতে তো তোমরাই ছিলে এতদিন অবশ্য সেটা আমি জানতাম।কিন্তু আমার সেই ভুলটাও তোমরা আজকে ভাঙিয়ে দিলে।।এখন আমার নিজের বলতে শুধু আমি নিজেই।।

নন্দিনী আস্তে আস্তে নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে গেল।।এত বছর সংসারে তাকে যে ঘুরিয়ে চোর বলতে পারে অভিরাজ,,সেটা সে কল্পনাতেও আনতে পারিনি।।।

____________________চলবে_________________


[ নতুন একটা ধারাবাহিক শুরু করলাম।।কেমন লাগলো আমাকে কমেন্টে জানাবেন প্লিজ।যদি ভালো লাগে তাহলে নেক্সট পর্ব দেবো।]


#গল্প #প্রেমের #বাংলাগল্প #NOW #today #facebookpost #FacebookPage

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.
Sedin Choitro Mash-Episode-10-Valobashar-Golpo-2025

Sedin Choitro Mash-Episode-10-Valobashar-Golpo-2025